প্রিয় শিক্ষার্থী, অনেকেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা লেখার অনুরোধ করেছ। তাই বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তোমাদের জন্য এই মুক্তিযুদ্ধের রচনাটি উপস্থাপন করা হল। আশা করি এটি তোমাদের কাজে লাগবে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম (Bangladesh Muktijuddho) একটি দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী অধ্যায়, যেখানে লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগ ও রক্তে রচিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। পাকিস্তানের শাসনামলে শোষণ ও বৈষম্যের শিকার হয়েছিল বাঙালি জাতি। তাদের অন্যায় আচরণের প্রতিবাদে বাংলার মানুষ ধীরে ধীরে আন্দোলনের পথে নামেন। সেই আন্দোলনই একসময় রূপ নেয় স্বাধীনতার সংগ্রামে। নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের পর ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে আমরা অর্জন করি আমাদের স্বাধীনতা, আর উদিত হয় স্বাধীন বাংলার সূর্য।
ভূমিকা
আমরা একটি স্বাধীন দেশের মানুষ। আমাদের এই স্বাধীনতার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের ইতিহাস। একজন পরাধীন জাতির জন্য স্বাধীনতা শুধুমাত্র একটি শব্দ নয়, এটি জীবনের মূল ভিত্তি। পরাধীন জাতির কোনো অধিকার থাকে না, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা তাদের ভেতরে জাগিয়ে তোলে সাহসিকতা এবং সংগ্রামী চেতনা। সেই সংগ্রামই তাদের মুক্তির পথে ধাবিত করে। আমরা বাঙালি জাতি, আমাদের স্বাধীনতা এসেছে বহু কষ্টের বিনিময়ে। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী এক মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করেছি আমাদের স্বাধীনতা। স্বাধীনতার সেই মহিমাময় অধ্যায়টি আমাদের জাতীয় জীবনের একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাষায়: “সাবাস বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়, জ্বলে-পুড়ে-মরে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়।”
মুক্তিযুদ্ধ কি
মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে এমন একটি যুদ্ধ যেখানে একটি জাতি স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লড়াই করে। এটি সাধারণ যুদ্ধের মতো সীমিত নয়, এটি আরো ব্যাপক এবং জীবন-মৃত্যুর লড়াই। ঔপনিবেশিক শাসন বা স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে জাতি তাদের নিজেদের অধিকার আদায় করতে চায়। এই মুক্তির যুদ্ধ কেবলমাত্র বাহিনীর লড়াই নয়, এটি রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম। মুক্তিযুদ্ধ মানে হচ্ছে একটি জাতির মুক্তির পথে ধাবিত হওয়া।
মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি
১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান আলাদা দেশ হিসেবে স্বাধীনতা লাভ করে। পাকিস্তান দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে যায় – পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ)। ধর্মীয় সামঞ্জস্যের ভিত্তিতে এই বিভক্তি হলেও সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত পার্থক্যের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ শোষিত হতে থাকে। তারা তাদের ভাষা, সংস্কৃতি এবং স্বায়ত্তশাসনের জন্য সংগ্রাম শুরু করে। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথম রক্ত দেয়। এরপর ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে। নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়, যা অবশেষে মুক্তিযুদ্ধের দিকে নিয়ে যায়।
স্বাধীনতার ঘোষণা
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকায় বাঙালিদের ওপর গণহত্যা চালায়। ওই রাতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তাঁর এই ঘোষণাটি চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে আওয়ামী লীগ নেতা এম. এ. হান্নান প্রচার করেন, যা সারা দেশে ব্যাপক আলোড়ন তোলে। পরবর্তীতে মেজর জিয়াউর রহমানও বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পুনরায় পাঠ করেন। এই ঘোষণার মাধ্যমে বাংলার জনগণ পূর্ণ মাত্রায় মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
অস্থায়ী সরকার গঠন
১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগরে (তৎকালীন বৈদ্যনাথতলা) বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি করা হয়। তাজউদ্দিন আহমদ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন। এ সরকার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে এবং আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রচেষ্টা চালায়।
মুক্তিবাহিনী গঠন ও যুদ্ধের প্রস্তুতি
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাচার থেকে বাঁচতে লাখ লাখ বাঙালি ভারতে আশ্রয় নেয়। তাদের মধ্য থেকে গঠিত হয় মুক্তিবাহিনী। কর্নেল এম. এ. জি. ওসমানীর নেতৃত্বে এই বাহিনী গেরিলা যুদ্ধ চালাতে শুরু করে। মুক্তিবাহিনী ১১টি সেক্টরে বিভক্ত হয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করে। এই সেক্টরগুলোতে সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণ
১৯৭১ সালের শেষ দিকে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় বাহিনী যোগ দেয়। যৌথ আক্রমণে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তীব্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, কিন্তু ভারত দ্রুত বাংলাদেশকে সহযোগিতা শুরু করে। ৬ই ডিসেম্বর ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ ও চূড়ান্ত বিজয়
১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করেন। প্রায় ৯৩,০০০ পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে, যা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় আত্মসমর্পণের ঘটনা। বাংলাদেশের বিজয় ছিনিয়ে আনা হয় মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস পর।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
১৯৭১ সালের ৬ই ডিসেম্বর ভুটান প্রথম বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। একই দিনে ভারতও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এ স্বীকৃতি বাংলাদেশের জন্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়টি তুলে ধরে এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত তৈরি করে।
মুক্তিযুদ্ধে বৈদেশিক সাহায্য
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিক সহায়তা ছিল অপরিহার্য। ভারতের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা বাংলাদেশকে সহায়তা করেছে। বিশেষ করে ভারতে আশ্রিত শরণার্থীদের জন্য ভারত সরকার এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন মানবিক সহায়তা দিয়েছে। ভারত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র এবং কৌশলগত সহযোগিতা প্রদান করে, যা মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
উপসংহার
স্বাধীনতা মানে শুধুই একটি দেশ বা জাতির মুক্তি নয়, এটি প্রতিটি মানুষের আত্মমর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার। শহীদ মিনারে যে একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল আলোয় আমরা প্রতিবছর প্রণাম জানাই, তা আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি এবং আত্মপরিচয়ের মূলে প্রোথিত স্বাধীনতার প্রতীক।
যারা একদিন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যারা শোষণমুক্ত, সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেছিলেন, তাঁদের অনেকেই আজ আর আমাদের মাঝে নেই। তাঁদের সেই নিঃস্বার্থ ত্যাগ ও আদর্শ আজ অনেক ক্ষেত্রে স্বার্থপরতার আড়ালে হারিয়ে যেতে বসেছে। আমাদের সমাজ ও রাজনীতির ভিতর অনেক সময় সেই আদর্শিক পতাকাটি বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
স্বাধীনতার চার দশকের বেশি সময় পেরিয়ে এলেও, অনেক বাঙালির জীবনযাত্রার মান এখনও কাঙ্ক্ষিত উচ্চতায় পৌঁছায়নি। দারিদ্র্য, বৈষম্য, ও দুর্নীতি এখনও দেশের অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করছে। কিন্তু তবুও আমরা আশাবাদী।
যদি আমরা অতীতের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে একসাথে কাজ করি, তাহলে স্বাধীনতার প্রকৃত মূল্যায়ন করতে পারব। প্রতিটি নাগরিকের অধিকার রক্ষা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমরা একটি সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারি। আমাদের সামগ্রিক প্রচেষ্টা একদিন এই দেশকে বিশ্বের বুকে একটি গর্বিত ও মর্যাদাপূর্ণ স্থানে প্রতিষ্ঠা করবে—এটাই আমাদের সবার স্বপ্ন।
আজও বাংলার মানুষ অপেক্ষা করছে একটি নতুন ভোরের, একটি নতুন সূর্যের, যে সূর্য আমাদের জীবনে আলো ছড়াবে এবং আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাবে একটি নতুন যুগের পথে।
আরও পড়ুন– বঙ্গবন্ধুর ছেলেবেলা বাংলা রচনা।