কৃষি মানুষের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্ষেত্র। আধুনিক যুগে কৃষি কাজে বিজ্ঞানের অবদান অসীম। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, ফসলের মান উন্নয়ন এবং চাষের খরচ কমাতে বিজ্ঞান ব্যাপকভাবে সাহায্য করছে। প্রথমেই বলা যায়, উন্নত মানের বীজ এবং সারের ব্যবহার কৃষিতে বিপ্লব ঘটিয়েছে। বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে এমন বীজ উদ্ভাবন করা হয়েছে, যা সহজে রোগ প্রতিরোধ করতে পারে এবং অল্প সময়ে বেশি ফলন দেয়। একইভাবে, সঠিক সারের ব্যবহারে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায় এবং ফসল ভালো হয়।এছাড়া সেচব্যবস্থায় বিজ্ঞান অনেক উন্নতি এনেছে। আগের দিনের নদী বা পুকুর থেকে পানি তোলার পদ্ধতির পরিবর্তে এখন সেচের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়, যেমন সোলার পাম্প বা ড্রিপ ইরিগেশন। এর ফলে সময় এবং পরিশ্রম দুটোই বাঁচে।
কৃষি কাজে বিজ্ঞান রচনা Class 10
কৃষি যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রেও বিজ্ঞানের অবদান অসামান্য। ট্র্যাক্টর, হালচাষ মেশিন, এবং ধান কাটার যন্ত্র কৃষকের কাজকে সহজ এবং দ্রুত করেছে। পাশাপাশি ফসল সংরক্ষণের জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গুদাম এবং প্রক্রিয়াকরণের প্রযুক্তি খাদ্যের অপচয় কমাতে সাহায্য করছে। সব মিলিয়ে, বিজ্ঞান কৃষিকে আধুনিক ও লাভজনক করে তুলেছে। তাই, কৃষিতে বিজ্ঞানকে গ্রহণ করা উন্নতির মূল চাবিকাঠি।
ভূমিকা
মানুষের জীবনধারা প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে, আর সেই সঙ্গে বদলে যাচ্ছে আমাদের গড়ে তোলা সভ্যতাও। একশ বছর আগের পৃথিবীর সঙ্গে বর্তমান সময়ের তুলনা করলেই এই পরিবর্তনের গভীরতা বোঝা যায়। সভ্যতার এই পরিবর্তনের মূলে রয়েছে বিজ্ঞান। মানুষের এই অগ্রগতির গল্প বিজ্ঞানের আবিষ্কার ছাড়া অসম্ভব। বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে গতি, সভ্যতাকে করেছে সমৃদ্ধ। প্রকৃতিকে জয় করার মতো ক্ষমতাও মানুষ বিজ্ঞানের মাধ্যমে অর্জন করেছে। বিশেষ করে কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অবদান অভাবনীয়। কৃষিতে বিজ্ঞানের স্পর্শ আমাদের জীবনে এনেছে বিপ্লব।
মানবসভ্যতা ও কৃষি
মানবসভ্যতার ইতিহাসে কৃষি এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। প্রাচীনকালে মানুষ যখন শিকার নির্ভর জীবনযাপন করত, তখন কৃষি আবিষ্কার মানবজাতির জীবনযাত্রায় স্থিতি এনেছিল। কৃষিই মানুষের প্রাচীনতম জীবিকার মাধ্যম। সভ্যতার উন্নতির ইতিহাসে দেখা যায়, যে দেশ বা সমাজ কৃষিতে অগ্রসর হয়েছে, সে দেশ তত দ্রুত উন্নতির শিখরে পৌঁছেছে। তাই, কৃষির উন্নতির সঙ্গে সমাজ ও সভ্যতার উন্নতির সম্পর্ক গভীর।
প্রাচীন যুগের কৃষি
প্রাচীন যুগের মানুষ ছিল প্রকৃতির দয়ায় বেঁচে থাকা। শিকার, সংগ্রহ এবং বন্য প্রাণীর আক্রমণের সঙ্গে লড়াইয়ের মধ্যে দিয়েই তাদের জীবন চলত। ঠিক এই সময়ে তারা কৃষিকাজের ধারণা আয়ত্ত করল। প্রথমদিকে মানুষেরাই নিজ হাতে লাঙল টেনে জমি চাষ করত। পরে গরু, মহিষ বা ঘোড়া ব্যবহার করে জমি চাষ শুরু হয়। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন বন্যা, খরা বা অনাবৃষ্টি সম্পর্কে তাদের কোনো পূর্বজ্ঞান ছিল না। একই জমিতে বারবার চাষ করার ফলে মাটির উর্বরতা কমে যেত। বীজ বপনের পদ্ধতি বা উন্নত ফসল উৎপাদন সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা না থাকায় প্রাচীন যুগের কৃষি উন্নত ছিল না।
মধ্যযুগের কৃষি
মধ্যযুগে কৃষিতে বড় ধরনের উন্নতি ঘটে। চাকার আবিষ্কার কৃষির কাজে নতুন গতি আনে। এসময় মানুষ বন-জঙ্গল কেটে কৃষিজমি বাড়াতে থাকে। নদী তীরবর্তী অঞ্চলের পলিমাটিতে ফসল ফলিয়ে তারা ভালো সাফল্য পায়। মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যের মঙ্গলকাব্যে কৃষি সম্পর্কিত বিভিন্ন উদ্ভাবনের কথা উল্লেখ পাওয়া যায়। এটি প্রমাণ করে, মধ্যযুগে কৃষি ধীরে ধীরে তার প্রসার ঘটাতে শুরু করেছিল।
আধুনিক কালের কৃষি
শিল্পবিপ্লবের সূচনা কৃষিতে এক নতুন যুগের দরজা খুলে দেয়। উন্নত যন্ত্রপাতি, উন্নত বীজ এবং রাসায়নিক সার কৃষিতে ব্যাপক উন্নতি আনে। কাঠের লাঙলের পরিবর্তে যন্ত্রচালিত চাষের প্রচলন শুরু হয়। সেচব্যবস্থা উন্নত হওয়ার ফলে খরার মধ্যেও ফসল ফলানো সম্ভব হয়। বিদ্যুৎচালিত পাম্পের মাধ্যমে শুষ্ক জমিতে ফসল ফলানোর প্রচলন ঘটে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস এবং মাটির মান বিশ্লেষণের মাধ্যমে কৃষকরা এখন আরও দক্ষভাবে চাষাবাদ করতে সক্ষম।
উন্নত দেশের কৃষি
উন্নত দেশগুলোতে কৃষিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। বীজবপন থেকে ফসল সংগ্রহ পর্যন্ত সবকিছুতেই আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার হচ্ছে। ময়োয়ার, রিপার, বাইন্ডার, এবং থ্রেশিং মেশিনের মতো যন্ত্রগুলো কৃষিকাজে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ফিলিপাইন, চীন, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলো আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে কৃষি উৎপাদন বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছে। জাপানের মতো দেশেও, যেখানে জমির উর্বরতা কম, সেখানে উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্য অর্জিত হয়েছে।
বাংলাদেশের কৃষি
বাংলাদেশে কৃষিতে বিজ্ঞানের ছোঁয়া এসেছে তুলনামূলকভাবে দেরিতে। এক দশক আগেও লাঙল এবং গরুর সাহায্যে জমি চাষের প্রচলন ছিল। এখনও কিছু কিছু অঞ্চলে এই পদ্ধতির ব্যবহার দেখা যায়। তবে বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, এবং ফল গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন সংস্থা উন্নত ফসল ও ফলের জাত উদ্ভাবনে সাফল্য পেয়েছে। এই উদ্ভাবনগুলো মাঠপর্যায়ে কৃষকদের জীবনযাত্রায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
বিজ্ঞানসম্মত কৃষির গুরুত্ব
বাংলাদেশের মতো দেশে কৃষি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। পুরোনো পদ্ধতিতে কৃষিকাজ করলে বর্তমানে আর সফল হওয়া সম্ভব নয়। উন্নত বিশ্বের মতো আমাদেরও ছোট জমিতে বেশি ফসল উৎপাদনের কৌশল আয়ত্ত করতে হবে। আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগেই কৃষি এবং কৃষকের সর্বোচ্চ সাফল্য অর্জন সম্ভব।
বৈজ্ঞানিক কৃষি ও অর্থনীতি
বিজ্ঞানসম্মত কৃষি আমাদের অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। কিছু কিছু ফসল আমরা বিদেশেও রপ্তানি করছি। পাটের জিন আবিষ্কারের ফলে পাট শিল্পের সম্ভাবনাও আবার উজ্জ্বল হয়েছে। বহু আগে থেকে আমরা চা রপ্তানিতে সাফল্য অর্জন করেছি। বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষিকাজের মাধ্যমে এই সাফল্য আরও বহুগুণে বাড়ানো সম্ভব।
উপসংহার
সবুজ আর শস্যসমৃদ্ধ বাংলাদেশে বিজ্ঞানের সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্য অর্জন সম্ভব। কৃষকদের আধুনিক প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহারে উৎসাহিত করতে সরকারি ও বেসরকারি উভয় উদ্যোগ প্রয়োজন। বিজ্ঞান যত কাজে লাগানো যাবে, ততই কৃষিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে। সঠিক দিকনির্দেশনা ও উদ্যোগের মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে আমাদের দেশ আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবে।